সংসদ নির্বাচন: তিন মিনিটেই একটি করে শুনানি

ডেস্ক রিপোর্ট :

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আপিল শুনানির প্রথম দিন শেষে ৫৬ জন তাদের প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে রিটার্নিং অফিসারদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) পাঁচ দিনে মোট ৫৫৮টি আপিল হয়। এর মধ্যে বাছাইয়ে বৈধ ৩১ জনের প্রার্থিতা বাতিল চেয়েও আপিল হয়। এসব আপিলের বিষয়েই রবিবার (১০ ডিসেম্বর) থেকে শুনানি শুরু হয়েছে। চলবে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

রবিবার প্রথম দিনে ৯৪টি আপিলের শুনানি ও রায় হয়। এর মধ্য দিয়ে ৫৬ জন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। ৩২টি আপিল নামঞ্জুর হয়েছে। স্থগিত রাখা হয় ৬টি আপিল। প্রার্থিতা ফিরে পাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন- কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. নাসিরুল ইসলাম খান। রয়েছেন মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে বিকল্পধারার প্রার্থী মাহী বি চৌধুরী। আলোচিত প্রার্থীদের মধ্যে আরও রয়েছেন- ডলি সায়ন্তনী ও হিরো আলমও।

এবারের নির্বাচনে গত ৩০ নভেম্বর নির্ধারিত সময়ে ৩০০ আসনে মনোনয়নপত্র জমা হয় ২ হাজার ৭১৬টি। এর মধ্যে বাছাইয়ের সময় রিটার্নিং অফিসাররা বাতিল করেন ৭৩১ জনের মনোনয়ন। সেসব প্রার্থীর মধ্যেই ৫৫৮ জন নির্বাচন কমিশনে আপিল করেন।

গতকাল রবিবার শুনানি ও রায় হওয়া ৯৪ আপিলের ৫৯টিই ছিল বাছাইয়ে বাদ পড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। এদের মধ্যে ৫২ জনের মনোনয়ন বাতিল হয়েছিল ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষরে ত্রুটি থাকায়। এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে যাদের বড় ধরনের ত্রুটি নেই সে রকম ৩৩ জনের আপিল মঞ্জুর করে নির্বাচন কমিশন। প্রার্থিতা ফিরে পাওয়াদের মধ্যে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও রয়েছেন।

গ্যাস বিল ও বিদ্যুৎ বিল বাকি থাকায় যাদের মনোনয়ন বাতিল হয়েছিল তাদের আপিল মঞ্জুর করেছে কমিশন। শুনানিও হয়েছে খুব দ্রুত। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একেকটি আপিলের শুনানি ও রায় ঘোষণা করা হয়েছে মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে।

সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার ছিল না

এবারের আপিল শুনানিতে গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিত থাকার সুযোগ রাখেনি নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন ভবন চত্বরে দুটি কম্পিউপটার ডিসপ্লের মাধ্যমে আপিল মঞ্জুর বা না-মঞ্জুরের তথ্য জানানো হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় শুনানি হয়েছিল সাংবাদিকদের উপস্থিতিতেই।

গতকাল রবিবার সকাল ১০টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এবারের আপিল শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষ হওয়ামাত্র রায় প্রকাশ করা হয়। রায়ে সন্তুষ্ট না হলে প্রার্থীর উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আপিল শুনানিতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। এ সময় অন্য চার কমিশনারসহ ইসি সচিব উপস্থিত ছিলেন।

প্রার্থিতা ফিরে পেলেন যারা

আপিলের সুবাদে যারা গতকাল প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন টাঙ্গাইল-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. ইউনুস ইসলাম তালুকদার, যশোর-২ আসনের স্বতন্ত্র এস এম হাবিবুর রহমান, জামালপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র মো. জিয়াউল হক জিয়া, ফরিদপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র মোহাম্মদ আরিফুর রহমান, নোয়াখালী-২ আসনের জাতীয় পার্টির তালেবুজ্জামান, যশোর-১ আসনের জাতীয় পার্টির মো. আক্তারুজ্জামান, কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মো. নাসিরুল ইসলাম খান (এ আসনে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু প্রার্থী রয়েছেন), গোপালগঞ্জ-১ আসনের স্বতন্ত্র মোহাম্মদ কবির মিয়া, খুলনা-৬ আসনে জাতীয় পার্টির মো. শফিকুল ইসলাম মধু, চট্টগ্রাম-৮ আসনের স্বতন্ত্র আবদুচ সালাম, বরগুনা-১ আসনের স্বতন্ত্র মো. খলিলুর রহমান, খুলনা-৪ আসনে তৃণমূল বিএনপির শেখ হাবিবুর রহমান, মেহেরপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র মোখলেসুর রহমান, রংপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র বিশ্বনাথ সরকার, ঢাকা-২০ আসনে বিএসপির মো. মিনহাজ উদ্দিন, ফরিদপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র মাহমুদা বেগম, চট্টগ্রাম-২ আসনের স্বতন্ত্র মোহাম্মদ শাহজাহান, মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে বিএনএফের মমতাজ সুলতানা আহমেদ, মাদারীপুর-২ আসনে বিএসপির ইউসুফ আলী সুমন, চট্টগ্রাম-১৫ আসনে স্বতন্ত্র আব্দুল মোতালেব, যশোর-৩ আসনে জাকের পার্টির মো. মহিদুল ইসলাম, ঢাকা-৫ আসনের স্বতন্ত্র মো. কামরুল হাসান, চট্টগ্রাম-১ আসনের স্বতন্ত্র মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন (আওয়ামী লীগ নেতা), যশোর-৩ আসনের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শেখ নুরুজ্জামান, মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের বিএনএফের মো. বাচ্ছু শেখ, যশোর-৩ আসনের স্বতন্ত্র মোহিত কুমার নাথ, কুষ্টিয়া-১ আসনের স্বতন্ত্র ফিরোজ আল মামুন, কুমিল্লা-২ আসনের জাতীয় পার্টির এটিএম মঞ্জুরুল ইসলাম, যশোর-৬ আসনের স্বতন্ত্র মো. আজিজুল ইসলাম, বরিশাল-৬ আসনের স্বতন্ত্র মো. শামসুল আলম, সিলেট-২ আসনের তৃণমূল বিএনপির মো. আব্দুর রব, কুমিল্লা-৫ আসনের স্বতন্ত্র সাজ্জাদ হোসেন, মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে বিকল্পধারার মাহী বি চৌধুরী, কুমিল্লা-৫ আসনের স্বতন্ত্র এ এম জাহের। এ ছাড়াও প্রার্থিতা ফিরে পাওয়াদের তালিকায় রয়েছেন বরগুনা-১ আসনের স্বতন্ত্র মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের স্বতন্ত্র সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গাইবান্ধা-১ আসনের স্বতন্ত্র শাহ সারোয়ার কবীর, শরীয়তপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা, ময়মনসিংহ-১১ আসনে বিএসিপির এ বি এম জিয়া উদ্দিন, নীলফামারী-১ আসনের স্বতন্ত্র মো. জয়নাল আবেদীন, লালমনিরহাট-২ আসনে বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. দেলাব্বর হোসেন, ঢাকা-১৩ আসনের বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মো. জাফর ইকবাল নান্টু, গাইবান্ধা-৫ আসনের স্বতন্ত্র ফারজানা রাব্বী রুবলী, কিশোরগঞ্জ-১ আসনের স্বতন্ত্র সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলাম, নেত্রকোণা-৫ আসনের স্বতন্ত্র মো. আনোয়ার হোসেন, জামালপুর-১ আসনের তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী মো. গোলাম মোস্তফা, পাবনা-২ আসনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রার্থী ডলি সায়ন্তনী, গাজীপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির এম এম নিয়াজ উদ্দিন, ঝালকাঠি-১ আসনের স্বতন্ত্র আবুল কাসেম মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, টাঙ্গাইল-৭ আসনের স্বতন্ত্র রাফিউর রহমান খান ইউসুফ জাই, শরীয়তপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র খালেদ শওকত আলী, সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের স্বতন্ত্র মো. হালিমুল হক মীরু, কুড়িগ্রাম-৪ আসনের বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. আব্দুল হামিদ, বগুড়া-৩ আসনের স্বতন্ত্র মো. আফজাল হোসেন, বগুড়া-৪ আসনের স্বতন্ত্র আশরাফুল আলম (হিরো আলম) এবং নেত্রকোণা-২ আসনের বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. আজহারুল ইসলাম খান।

প্রার্থীকে হাইকোর্টে যেতে বললেন সিইসি

আপিল শুনানিতে অংশ নিতে নির্ধারিত সময়ের ৩৮ মিনিট আগেই কমিশনে উপস্থিত হন টাঙ্গাইল-৬ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী এ টি এম আনিসুর রহমান বুলবুল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই তার বিষয়ে শুনানি শেষ করে ফেলে ইসি। যথাসময়ে এলেও তাকে কমিশন ডিসকোয়ালিফায়েড করে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। এ ছাড়া সিইসি তাকে পুলিশ দিয়ে বের করে দিয়েছেনÑ এমন অভিযোগও করেছেন সাংবাদিকদের কাছে। বুলবুল বলেন, ‘আমি হাইকোর্টে যাব। আমি বলেছি, আমার মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।’

প্রার্থিতা ফিরে পেলেন হিরো আলম

বগুড়া-৪ আসনে বাংলাদেশে কংগ্রেসের প্রার্থী আলোচিত ইউটিউবার হিরো আলমের আপিল মঞ্জুর করেছে ইসি। গতকাল বেলা ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে আপিল শুনানি শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ রায় দেন। এর ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হিরো আলমের জন্য আর কোনো বাধাই থাকল না।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হিরো আলম বলেন, ‘বগুড়া-৪ আসন থেকে বাংলাদেশ কংগ্রেসের ডাব প্রতীকে আমি এবার নির্বাচন করছি। আমি আগেই একটি কথা বলেছিলাম, এবার আমরা নির্বাচন অফিস থেকেই প্রার্থিতা ফিরে পাব। আমার ছোট কয়েকটি ভুল ছিল। এগুলো বগুড়াতেই সংশোধন করে দেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু কিছু লোকের ষড়যন্ত্রের কারণে তা হয়নি। আমার বিশ্বাস ছিল, এখান থেকে প্রার্থিতা ফেরত পাব এবং সেটি সত্য হয়েছে।’

সাদিক আবদুল্লাহর বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরে

নির্বাচন কমিশন গতকাল ৬টি আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখে। এগুলো হচ্ছেÑ ঢাকা-১২ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী খোরশেদ আলম খুশু, কক্সবাজার-১ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমদ, খুলনা-৫ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. শহীদ আলম, বরিশাল-৫ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহিদ ফারুক (স্বতন্ত্র প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহর প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে), লক্ষ্মীপুর-১ আসনের তৃণমূল বিএনপির এম এ আওয়াল এবং সিলেট-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহিবুর রহমানের আপিল।

বরিশাল-৫ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক স্বতন্ত্র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে আপিল করেছিলেন। সাদিক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে হলফনামায় তার নিজের ও স্ত্রীর সম্পদের তথ্য গোপন করার ও দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগ করা হয়। গতকাল আপিলে উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনলেও নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দেওয়ার বিষয়টি স্থগিত রাখে। সাদিক আবদুল্লাহর আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, দ্বৈত নাগরিকত্বের যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে, তা সঠিক না। সেখানে উল্লেখিত এস আবদুল্লাহ আর সাদিক আবদুল্লাহ এক ব্যক্তি নন। সাদিক আবদুল্লাহর স্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদের যে তথ্য জানানো হয়েছে তারও আইনগত গ্রহণযোগ্যতা নেই। নির্বাচন কমিশন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদের তথ্য সঠিক কি না, তা যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে খোঁজ নেওয়ার এ আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।